রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৫২ পূর্বাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
বাজারে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। অস্বীকার করার উপায় নেই, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে কিন্তু এর তুলনায় দ্রব্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি। ফলে নিম্নআয়ের মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। অধিক মুনাফালোভীরা তাদের গুদামে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য বিশেষ করে সয়াবিন তেল অবৈধভাবে মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। এর আগেও আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে গুদাম থেকে বস্তা বস্তা পচা পেঁয়াজ নদীতে ফেলার দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রচার হতে দেখেছি।
বাজার ব্যবস্থাসহ নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরের ব্যবধানে নিত্যদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িত পণ্য ও সেবার দাম ৩ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার হার আরও বেশি। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি, বরং বিপুলসংখ্যক মানুষের আয় কমেছে। অবস্থা এমন হয়েছে, সাধারণ মানুষ আগে যে ধরনের ও পরিমাণে পণ্য কিনতেন, বর্তমান সময়ে সে তুলনায় নিম্নমান ও পরিমাণে কম জিনিসপত্র কিনছেন। করোনা-পরবর্তী বাড়তি চাহিদা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে পণ্যের দর বেড়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন উপায়ে সরকার পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করলেও বাজারে শক্তিশালী তদারকি না থাকায় এসব উদ্যোগ মানুষের তেমন উপকারে আসছে না। এমতাবস্থায় সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি।
মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে মোটাদাগে যে বিষয়গুলো সামনে আসে তা হলোএকশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকারও তাদের কাছে জিম্মি। দায় এড়ানোর জন্য এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবের কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো দ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে দেশীয় বাজারেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো দ্রব্যের দাম কমলে দেশীয় বাজারে তা কমে না। বরং অতিরিক্ত মুনাফা তৃতীয় পক্ষের পকেটে চলে যায়। উল্লিখিত কারণ ছাড়া দালাল এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের অপতৎপরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক এবং ব্যবসায়ীদের ওপর নানা নামে চাঁদা ধার্য মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তা ছাড়া বিভিন্ন সেতু ও মহাসড়কের ঘাটে ঘাটে টোল প্রদানের কারণে পণ্যদ্রব্যের পরিবহন খরচ বৃহদাংশে বৃদ্ধি পায়। এসব সমস্যার যৌক্তিক সমাধানেই সম্ভব দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলাম এমনসব কল্যাণধর্মী নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যা বাস্তবায়িত হলে অনায়াসে মুদ্রাস্ফীতিরোধ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বর্ণিত কারণসমূহ সমাধানে ইসলামের নির্দেশনা ও দৃষ্টিভঙ্গি হলো
প্রথমত: দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে যদি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অন্যায়ভাবে কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দেয়, এক্ষেত্রে সরকারের ওপর কর্তব্য হচ্ছেবাজারে হস্তক্ষেপ করে দ্রব্যমূল্যের ন্যায্যদাম নির্ধারণ করে দেওয়া। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও যদি পণ্যের মালিকগণ প্রচলিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে তা বিক্রয় করেন, তখন তাদের প্রচলিত দামে বিক্রি করতে বাধ্য করা ওয়াজিব।’ আল হিসবাহ ফিল ইসলাম : ১৯-২০
দ্বিতীয়ত: দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলাম মজুদদারিতা নিষিদ্ধ করেছে। যে ব্যক্তি (সংকট তৈরি করতে) খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অপরাধী। তবে গুদামজাত পণ্য যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় হয় কিংবা চাহিদার অতিরিক্ত হয়, তাহলে পণ্য মজুদ রাখা অবৈধ নয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যদ্রব্য ৪০ দিন পর্যন্ত মজুদ করে রাখে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ ইবনে মাজাহ
মজুদদারের ঘৃণ্য মানসিকতার নিন্দা করে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মজুদদার কতই না নিকৃষ্ট! দ্রব্যমূল্য হ্রাসের খবর তার কাছে খারাপ লাগে; আর মূল্যবৃদ্ধির খবরে সে আনন্দিত হয়।’ অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘মজুদদারের ওপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল ও মানবজাতির অভিশাপ। আল্লাহতায়ালা তার ফরজ, নফল কোনো ইবাদতই কবুল করেন না।’ ফতোয়ায়ে শামি : ৬/৩৯৮
তৃতীয়ত: ফড়িয়া, দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীরা উৎপাদকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে বাজারদর বাড়িয়ে ফেলে। তাই হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ করেছেন। এমন অপতৎপরতার মাধ্যমে যেন পণ্যের দাম বাড়তে না পারে সেজন্য হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) গ্রামবাসীর পক্ষ হতে অন্য কাউকে দ্রব্য বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। হজরত আনাস বিন মালেক (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমাদের নিষেধ করা হয়েছে যে, শহরের লোক যেন গ্রামের লোকের পক্ষ হয়ে বিক্রয় না করে।’ সহিহ মুসলিম : ৩৬৮৭
চতুর্থত: ঊর্ধ্বগামী মূল্যের জিনিস পরিহার করা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের অন্যতম একটি উপায়। হজরত ওমর (রা.)-এর যুগে লোকেরা এসে তার নিকট গোশতের মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ করে। তখন তিনি বললেন, ‘তোমরাই এর মূল্য হ্রাস করে দাও। তখন লোকেরা বলল, আমরা কি গোশতের মালিক যে, এর মূল্য কমিয়ে দেব? তখন তিনি বললেন, তাদের নিকট থেকে গোশত কেনা ছেড়ে দাও।’ আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া
পঞ্চমত: অল্পে তুষ্টি এবং অপচয়রোধ। মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলোজিহ্বা কথা বলার সময় যেমন সংযত রাখে, তেমনি খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের ক্ষেত্রেও। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার ভাগ্যে আল্লাহ যা নির্ধারণ করে রেখেছেন, তাতে খুশি থাকলে তুমি হবে সবচেয়ে সুখী মানুষ।’ সুনানে তিরমিজি : ২৩০৫
এভাবেই ইসলাম নাগরিকদের কল্যাণে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্য উৎসাহিত করতে যেমন বিভিন্ন রকম জাগতিক ও পারলৌকিক প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে, তদ্রুপ বিভিন্ন ধরনের নৈরাজ্যকর ও অবাঞ্ছিত পদক্ষেপ প্রতিরোধে জাগতিক এবং পারলৌকিক শাস্তিও ঘোষণা করেছে। ইসলাম মানবতাকে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রদান করে, যা সব বৈষম্য ও অসমতা দূর করে ইনসাফভিত্তিক এক অনন্য সমতার সমাজ কায়েমের পথ নির্দেশ করে। এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজের কোনো ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার ক্ষুন্ন এবং কারও স্বার্থ বিনষ্টের কোনো সুযোগ নেই। তাই মুমিন হিসেবে আমাদের উচিত ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিবিধান মেনে চলা এবং অতিরিক্ত মুনাফা, মজুদদারি, কালোবাজারিসহ অবৈধ সব পন্থায় লেনদেন ও অর্থ উপার্জন থেকে বিরত থাকা।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক